শিরোনাম
কাচিয়া ইউনিয়ন পরিষদ ভবন এর পূর্ণমান ছবি
বিস্তারিত
কাচিয়া ইউনিয়ন পরিষদ ভবন।
১৮৬১ সালে তত্কালীন অর্থমন্ত্রী বাজেট ঘোষণার সময় মত প্রকাশ করেন যে, স্থানীয় এলাকায় উন্নতির জন্য কিছু ক্ষমতা স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর অর্পণ করা প্রয়োজন। ১৮৬৯ সালের ১৪ই ডিসেম্বর লর্ডমেয়ো স্থানীয় এলাকার উন্নতির জন্য গুরুত্ব আরোপ করেন। তারপর ১৮৮২ সালে রর্ড রিপনই সর্ব প্রথম এদেশে বাস্তবে স্থানীয় স্বায়ত্ত শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জনসাধারণকে অধিকতর রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চেয়েছেন। লর্ড রিপনের এ প্রস্তাবনার প্রতি তত্কালীন ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী গ্লাডস্টোনের পূর্ণ সমর্থন ছিল। এরপর লর্ড রিপন ১৮৮২ সালের ১৮ই মে ঐতিহাসিক প্রস্তাবনা ঘোষণা করেন। তার প্রস্তাবনার ভিত্তিতে ১৮৮৩ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলায় বিধান সভায় একটা বিল উত্থাপন করা হয়। উক্ত প্রস্তাবনায় গ্রাম এলাকায় জনসাধারণের কল্যাণের জন্য প্রথম ইউনিয়ন কমিটি গঠন করা হয়।
১৮৮৫ সাল থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত বর্তমান ইউনিয়ন পরিষদের নাম ছিল ইউনিয়ন কমিটি। হাওড়া জেলা প্রশাসক ই কে ওয়েস্টম্যান কোট নামে একজন আই.সি.এস অফিসারকে এ বিষয়ের জন্য বিশেষ দায়িত্বে নিয়োগ করা হয়। অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি বর্ধমান প্রেসিডেন্সী/ ডিভিশন এবং ঢাকা জেলার মুন্সীগঞ্জ মহকুমার মধ্যে প্রথম ১৮০টি ইউনিয়ন কমিটি গঠন করেন। ১৮৮৪ সালের ৩১শে মার্চ সরকার এক প্রস্তাবনার মাধ্যমে বিষয়টি গ্রহণ করেন। কিন্তু তত্কালীন সেক্রেটারী জেনারেলের বিরোধিতার জন্য আইনটি পাস হতে বিলম্ব ঘটে। অতঃপর ১৮৮৫ সালের মার্চ মাসে মিস্টার ম্যাকুলে বিলটি পুনঃ উত্থাপন করেন। ঐবছর ৪ঠা এপ্রিল বিলটি চূড়ান্তভাবে পাস করা হয়। আজকে আমরা যে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের বা ইউনিয়ন পরিষদের সুফল ভোগ করছি, তা ১৩০ বছর পূর্বে লর্ড রিপনই প্রথমে সুপারিশ এবং প্রতিষ্ঠার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন।
১৮৮৫ সালের আইনে তিনস্তর বিশিষ্ট গ্রাম স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়। স্তরগুলো হল (১) জেলা কমিটি, (২) থানা কমিটি ও ইউনিয়ন কমিটি। তখন এর সদস্য সংখ্যা ছিল ৫ থেকে ৯ জন। তারা ইউনিয়নের অধিবাসীদের দ্বারা নির্বাচিত হতেন। প্রথম অবস্থায় ইউনিয়ন কমিটির চেয়ারম্যান পদ ১৮৮৫ সালের বিধানে ছিল না। ১৯০৮ সালে পশ্চিম বাংলায় ১৮৮৫ সালের আইনের সংশোধন কালে চেয়ারম্যান পদের সৃষ্টি করা হয়। সে অনুসারে ১৯১৪ সালে পূর্ব বাংলায় প্রচলিত হয়। তখন সদস্যগণের মধ্য থেকে চেয়ারম্যান নিয়োগের প্রথা ছিল। ইউনিয়ন কমিটির কার্যকাল ছিল মাত্র ২ বছর। ১৮৯৬-৯৭ সালে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন নিয়ে পুনরায় চিন্তাভাবনা করা হয়। সে সময় পূর্ব বাংলায় ছিল প্রবল বন্যা। এই বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য তখন প্রথম ইউনিয়ন কমিটির হাতে স্থানীয় করারোপ করা ছাড়াও কিছু ক্ষমতা প্রদান করা হয়।
১৯১৩ সালে মিস্টার লিভিঞ্জের সভাপতিত্বে অন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। উক্ত কমিটি স্থানীয় স্বায়ত্ত শাসনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মতামত প্রদান করতে সক্ষম হয়। উক্ত ইউনিয়ন কমিটি বাতিলের জন্য পরামর্শ দেয়। ১৯১৮ সালের ২৪শে এপ্রিল স্যার সুরেন্দ্র প্রাসানা সিন্হা ১৮৭০ সালের গ্রাম পঞ্চায়েতী আইন এবং ১৮৮৫ সালের ইউনিয়ন কমিটি ভেঙ্গে একটি নতুন কমিটি গঠন করার সুপারিশ পেশ করেন। নতুন এই কমিটির নামকরণ করা হয় ইউনিয়ন বোর্ড। ১৯১৯ সালের ২১শে জানুয়ারি মিস্টার হেনরী হুইলার বিলটি সিলেক্ট কমিটির নিকট পেশ করেন। আলোচনাকালে জনাব শের-ই-বাংলা এ কে এম ফজলুল হক জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের পরিবর্তে ইউনিয়ন বোর্ডকে জেলা বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সুপারিশ করেন। বিলটির উপর সামান্য আলোচনা-সমালোচনার পর ঐ বছরই গ্রাম স্বায়ত্ত শাসন আইন ১৯১৯ সালে পাস হয়। উক্ত আইনে বলা হয়, সাধারণত গড়ে ১০টি গ্রাম নিয়ে একটি ইউনিয়ন বোর্ড গঠিত হবে। ইউনিয়নের গড় আয়তন ছিল ১০ থেকে ১৫ মাইলের মধ্যে, এর গড় জনসংখ্যা ছিল ১০ হাজার। পিরোজপুর জেলার প্রায় ইউনিয়নই ১৯১৯ সালের আইন অনুযায়ী ১৯২০ সাল থেকেই ইউনিয়ন বোর্ড চালু হয়। উক্ত ইউনিয়ন বোর্ডের কার্যকাল ছিল ৩ বছর। স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি সর্ব প্রথম স্থানীয় স্বায়ত্ত শাসন বিষয়ক মন্ত্রী হন। ১৯৩৫ সালে ইউনিয়ন বোর্ডের কার্যকাল ৪ বছর করা হয়। এই আইনে প্রেসিডেন্ট ছাড়াও একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৫৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান আইন নং ৩৫ গৃহীত হলে ১৯১৯ সালে আইন সংশোধন করা হয়। প্রকাশ্যে ভোটদান বাতিল, গোপন ব্যালটে ভোট চালু হয়। ইউনিয়নকে ৩টি ওয়ার্ডে বিভক্ত করা হয়। এই আইনে সর্বপ্রথম নারীদের ভোটাধিকার দেয়া হয়।
১৯৫৯ সালের ২৭শে অক্টোবর ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্র চালু করে। ইউনিয়ন বোর্ডের নাম পরিবর্তন করে নাম রাখেন ইউনিয়ন কাউন্সিল। উক্ত ইউনিয়ন কাউন্সিলের কার্যকাল ছিল ৫ বছর। ভাইস চেয়ারম্যান পদ ১৯৬৫সালে বাতিল করা হয়। ১৯৭১ সালে ইউনিয়ন কাউন্সিলের নাম পরিবর্তন করে নাম রাখা হয় ত্রাণ কমিটি। ১৯৭২ সালের ১লা জানুয়ারি ইউনিয়ন কাউন্সিল ও ত্রাণ কমিটি ভেঙ্গে ইউনিয়ন পঞ্চায়েত নামকরণ করা হয়। ১৯৭২ সালের ১৪ ডিসেম্বর নতুন সংবিধান প্রণীত হয়। ১৯৭৩ সালের ৩০শে জুন জাতীয় সংসদ কর্তৃক বিধি প্রণীত হয়। ইউনিয়ন পঞ্চায়েত-এর নাম পরিবর্তন করে নাম রাখা হয় ইউনিয়ন পরিষদ। জিয়ার সামরিক শাসনামলে ১৯৭৬ সালের ২০শে নভেম্বর স্থানীয় স্বায়ত্ত শাসন অধ্যাদেশ জারি করা হয়। ইউনিয়ন পরিষদের নাম ঠিক রেখেই সব সরকার কাজ চালিয়ে যান। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে ৩টি ওয়ার্ডের পরিবর্তে ৯টি ওয়ার্ড সৃষ্টি করেন এবং ৩ জন মহিলা সদস্যকে সরাসরি নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়। ইউনিয়ন পরিষদের এই সুদীর্ঘ ইতিহাস থাকলেও এই পরিষদকে শক্তিশালী ও স্বয়ংসম্পূর্ণ করার পথ এখনও বহু দূরে। আমরা স্থানীয় সরকারের আরও বিকাশ ও উন্নয়ন কামনা করি।